আমাদের রাজনীতির প্রতি ভুল ধারণা ১০১

রাজনীতি মানে কি?

রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের সবার মধ্যে কিছু সাধারণ ভুল ধারণা আছে। আমরা রাজনীতি বলতে শুধু দলীয় রাজনীতিকে বুঝে থাকি, যেখানে দুই-তিনটি দলের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়াই চলে। কিন্তু আসলে রাজনীতি এর চেয়ে অনেক বিস্তৃত। রাজনীতি বলতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং নৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন বোঝায়, যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এটা শুধুমাত্র ভোট দেওয়া বা নেতাদের সমর্থন করা নয়, বরং এটি প্রতিটি সামাজিক সম্পর্ক, আলোচনা, এবং মতামতের মধ্যে বিদ্যমান। যেদিন POL101 – Introduction to Politics কোর্সে প্রথম ক্লাস করেছিলাম, সেদিনই এই ভুল ধারণাটি আমাদের মাথা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমরা অনেকেই নিজেদের নিরপেক্ষ বা রাজনীতিমুক্ত বলে দাবি করি। কিন্তু বাস্তবে কেউই রাজনীতির বাইরে নয়। আপনি রাজনীতির বাইরে থাকতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপনি সম্পূর্ণ একা একটি নির্জন দ্বীপে বাস করেন। অন্য কেউ সেই দ্বীপে এলে, সেখানে রাজনীতি ঢুকে যাবে। কারণ, মানুষ যখন একসাথে থাকে, তখন কিছু নিয়ম, আলোচনা, এবং মতবিনিময় হতে শুরু করে, যা আসলে রাজনীতিরই অংশ। সুতরাং আপনি রাজনীতিমুক্ত না, আপনি চাইলে না চাইলেও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যান।

“আমি রাজনীতি পছন্দ করি না” বলা মানে কি?

যখন আপনি বলেন, “আমি রাজনীতি পছন্দ করি না,” আপনি আসলে ফ্যাসিস্টদের পরিকল্পনায় পা দেন। ফ্যাসিস্টরা সবসময় চায় সাধারণ মানুষ প্রকৃত রাজনীতি থেকে দূরে থাকুক, যাতে তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে পারে। যখন জনগণ রাজনীতি থেকে দূরে থাকে, তখন ফ্যাসিস্ট বা একনায়করা নিজেদের মতামত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়। বাস্তব রাজনীতি থেকে দূরে থাকলে জনগণের অধিকার হারিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে একজন ফ্যাসিস্ট শাসকের হাতে সবকিছু চলে যায়।

আমরা যখন সাম্প্রতিক আন্দোলন দেখি, অনেকেই বলে যে এটি একটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। কিন্তু আসলেই কি তা? “সাধারণ শিক্ষার্থী” বলতে কি বুঝি আমরা? তাদের কি নিজেদের কোন মতাদর্শ নেই? তারা কি কোন দলকে সমর্থন করে না, ভোটে অংশগ্রহণ করে না? তাহলে কিভাবে তারা একদম নিরপেক্ষ হতে পারে? কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ ছাড়াই তারা রাজনীতি করছে, এমনটা বলা কি বাস্তবসম্মত?

রাজনৈতিক মতাদর্শ লুকানোর কৌশল

আপনারা দেখছেন, আন্দোলনের সমন্বয়কদের পরিচয় ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। এ নিয়ে হয়তো অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন, বিষয়টা নিয়ে কেউ কেউ বিরক্তও হচ্ছেন। শিবিরের গোপনে রাজনীতি করার কৌশল তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশলের অংশ ছিল। এটা ভুল বা সঠিক—এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তাদের মতাদর্শকে অস্বীকার করতে পারবেন না। এরা আপনার আমার চারপাশেই ছিলো। আপনি আমি চিনতাম না এইটা তাদের কৌশলের কারণেই। একইভাবে, বাকি সমন্বয়করদেরও কোনো না কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ অবশ্যই আছে। এইটা মানতে না পারা আসলে বোকার রাজ্যে বসবাস করার মত বিষয়।

হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এতটাই দমিত হয়েছে যে মানুষ তাদের মতাদর্শ প্রকাশ করতে ভয় পায়। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে সেই মতাদর্শ প্রকাশিত হচ্ছে। তারা গর্তে ছিলো বিষয়টা এমন না। আপনি যদি মনে করেন যে তারা গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে, তাহলে বলতে হয় যে আপনি নিজেও গত ১৬ বছর তেমন একটা প্রশ্ন করেননি বা তথাকথিত নিরপেক্ষতা দেখিয়ে গিয়েছেন। হাসিনার বলা সব দলই খারাপ বা রাজনীতিই খারাপের ন্যারেটিভের উপর দাঁড়ায় ছিলেন। এই নিরপেক্ষতা আসলে সেই গর্তের বাসিন্দাই বানিয়ে রেখেছিলো আপনাকেও।

আন্দোলনের সময় আসলে অনেকেই অনেকের পরিচয় জানতো, কিন্তু চুপ করে সবাই এক হয়েছিলো কারণ তখন সকলের শত্রু ছিলো এক খুনি হাসিনা। সেখানে নিরপক্ষে সহ নানান দলের মানুষ ছিলো। কিন্তু সবাই নিরপেক্ষ থাকার কৌশল অবলম্বন করছে, দলীয় ব্যানারের বাইরে ছিলো শুধুমাত্র যেন আন্দোলন ঠিক ট্র্যাকে থাকে। যেমন আমাকেই সমন্বয়ক হওয়ার প্রস্তাব আসলে আমি সরাসরি মানা করে দেই। আমি বুঝায় বলি আমার সাথে যেহেতু প্রকাশ্যে দলের ইনভলভমেন্ট আছে তাই আমি মনে করি আমার এইখানে যুক্ত হয়ে যাওয়াটা সরাসরি আন্দোলনকে বাধাগ্রস্থ করবে। আমি মাঠে আছি, সমন্বয়ক এমন কাউকে দিলে ভালো হয় যার রাজনৈতিক মতাদর্শ আমরা কেউ না জানি। এতে আমাদের সবার জন্যই ভালো হয়। এইগুলা আসলে ভালো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কাপুরুষতা নয়। এইটা শত্রুকে গোপনে আঘাত করার কৌশল।

বাস্তবতা মেনে নেওয়া কঠিন

অনেকেই বাস্তবতাকে মেনে নিতে চান না। যেমন, গত ১০ বছর ধরে সবচেয়ে বেশি শোনা কথা ছিল বিএনপি শেষ, তারা আর কখনো উঠে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু আমি সবসময় বলেছি, হয়তো ২০ বছর পর হলেও তারা আবারও উঠে দাঁড়াবে। ঠিক যেমন এখন আমি বলি, আওয়ামী লীগও ভবিষ্যতে উঠে দাঁড়াবে। এইটাই কঠিন বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে মেনে না নিয়ে পরিবর্তনে হাত দেওয়া যাবে না। হাত দিলেও খুব বেশি একটা পজিটিভ চেঞ্জ আসলেও আসবে না।

তথ্য দিয়ে যদি প্রমাণ করতে চাই, তাহলে বলি—গত ১৬ বছরে বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। এটা কত বড় সংখ্যা তা একটু তুলনা করে দেখাই। দেশের টোটাল ভোটার প্রায় ১১ কোটির কাছাকাছি। অর্থাৎ এই ৬০ লাখ গায়েবী মামলা খাওয়া কর্মীরা দেশের মোট ভোটার সংখ্যার ৬%। আর শুধুমাত্র এদের পরিবারকেই ধরলে দেশের মোট ১২% থেকে ১৮% ভোটার বিএনপির সমর্থক। এর বাইরে আমার মত এমন অনেক মানুষ আরো আছে, তাদের পরিবার আছে। তখন এই সংখ্যাটা কত বড় হয়ে দাঁড়ায় ধারণা করতে পারছেন? এমন ঠিক আওয়ামীলীগের ক্ষেত্রেও তো আছে তাই না? জানেন অনেকে এখনও আসলেও বিশ্বাস করে হাসিনা কিছু করে নাই, তাকে আসলে ভুলভাল বুঝানো হইছিলো যার কারণে তার এই পরিণতি। রাতারাতি কি এই এত বড় সংখ্যক মানুষের মনোভাব চেঞ্জ করতে পারবেন? চেষ্টা করতে পারেন, তবে জোর খাটাইলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে সবার আগে।

সুতরাং, রাজনীতি নিয়ে আমাদের ভুল ধারণাগুলোকে ভাঙতে হবে এবং বুঝতে হবে যে রাজনীতি আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকেই প্রবাহিত। আমরা যতই এটাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি, ততই এটি আমাদের প্রভাবিত করে। রাজনীতি শুধুমাত্র সরকার বা রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়; এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্যাপ্ত। আমরা বুঝে-শুনে, প্রশ্ন করে করে, যুক্তি ও বাস্তবতার ভিত্তিতে আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করবো এবং সেইসাথে অন্যদের অধিকারও রক্ষা করবো। রাজনীতির মধ্যে থেকেই আমরা সমাজের সঠিক নীতি নির্ধারণে অবদান রাখতে পারি এবং সবার জন্য সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারি। রাজনীতির প্রভাব থেকে পালিয়ে বাঁচা নয়, বরং সেটাকে সঠিক পথে পরিচালিত করাই আমাদের আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

2 thoughts on “আমাদের রাজনীতির প্রতি ভুল ধারণা ১০১”

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *