বাংলাদেশঃ একটি প্রেশার কুকার কেস স্টাডি
বিগত এক দশকের দিকে তাকালে, বাংলাদেশী সমাজে আমরা একটি আশঙ্কাজনক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারি। আগে যেখানে মানবতা, সহানুভূতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল আমাদের বৈশিষ্ট্য, সেখানে আজকের প্রেক্ষাপটে আমরা ক্রমশ হয়ে উঠেছি অসহিষ্ণু, রুক্ষ, এবং কখনো কখনো ভয়ঙ্করভাবে মানসিকভাবে হিংস্র। আমি এই হিংস্রতা বললেই যে শারীরিকভাবে ক্ষতির কথা বলছি তা নয়, বরং এমন এক ধরনের আক্রমণ যা মানুষের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে, যা জান-মালের ক্ষতির চাইতেও গভীর প্রভাব ফেলে।
আমাদের দেশে যে ধরনের অসহিষ্ণুতা এবং মানসিক চাপের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, তা আমাদের জন্য প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আমরা যেন প্রতিটি দিন প্রেশার কুকারের মতো একটি সংকীর্ণ জায়গায় আরও বেশি চাপের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি, এবং সেই চাপ আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলনেও ফুটে উঠছে।
তাহলে কী কারণে আমরা এমন হয়ে উঠলাম? এর পেছনে যে মূল কারণটা কাজ করছে, তা হলো সরকারের প্রতি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকারের অন্যায় কার্যকলাপ, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, এবং আমাদের বাক স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা সব মিলিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের জমাট বাঁধা ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
আমরা কি আসলে স্বাধীন? সরকার যেন প্রতিনিয়ত আমাদের গলার কাঁটা ধরে আছে। প্রতিবাদ করতে গেলে যেন তার জবাবদিহিতার চেয়েও বড় কোনো বিপদে পড়তে হয়। এই পরিস্থিতি আমাদের ভেতরে এক অদৃশ্য চাপ তৈরি করেছে। একদম প্রেশার কুকারের মতো, যেখানে ভিতরের চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে সব ঠিকঠাক আছে। অথচ আসল ঘটনা হলো, আমরা অপেক্ষা করছি এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের।
এই প্রেশার কুকারের ঢাকনাটা খুলে দেওয়া প্রয়োজন। যদি সময়মতো এই চাপ নিরসন করা না হয়, তবে এই দেশ একদিন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে, যেখানে সামাজিক ও মানসিক বিস্ফোরণ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
আমাদের সবার এই মানসিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দরকার বাকস্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এগুলোর অনুপস্থিতিতে আমাদের সামাজিক পরিবেশ ক্রমেই আরও চাপ ও হিংস্রতায় পূর্ণ হবে, এবং শেষ পর্যন্ত প্রেশার কুকারের মতো বিস্ফোরিত হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশের জনগণ এখন পরিবর্তন চায়। আমাদের জমিয়ে রাখা মানসিক চাপ যতই বাড়ছে, ততই আমরা নিজেদের প্রকৃত মানসিক অবস্থার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব হলো এই চাপ নিরসন করা, নাহলে আমরা কেবল অপেক্ষা করব সেই অনিবার্য বিস্ফোরণের জন্য, যা দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং আমাদের সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলবে। প্রাথমিক ভাবে এই আঘাতটা আসবে এই সরকারের উপর যেহেতু তারাই আমাদের গলার আওয়াজকে চেপে ধরেছে। কিন্তু এরপরও আমাদের মুক্তি আসলে আসবে না। এই মানসিক চাপ আর তার পরবর্তী বিস্ফোরণের একটা পরিণাম আমাদের আরো ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।